ত্র্যহস্পর্শ নিয়ে দু-চার কথা
পন্ডিতদের মতে,মাগধী অবহট্টের পূর্বী ডায়ালেক্ট থেকে বাঙলা ভাষার আত্মপ্রকাশ মোটামুটি হাজার বছর আগে, তার মানে, কম বেশি ১০১৯ বা একাদশ শতকে।
তাঁরা আরও জানান যে বাঙলায় তুর্কী অনুপ্রবেশ দ্বাদশ শতকে।
চর্যাপদের কালও ওই একই সময় ধরে।
এই তিনটে ঘটনার মধ্যে অবশ্যই একটা যোগসূত্র আছে।
আরও বেশি যোগ ধর্মচিন্তাতেও।সাবেক আর্যভারতীয় ধর্মধারণা ছিল শৈব, সে লৌকিক শিবের পরিচয ছিল লিঙ্গ-প্রতীকে-শতিনি উর্বরতআজও শিবলিঙ্গের মাথায মেয়েরা জল ঢালে শিবরাত্রির দিন, শিবের মত বর পাওয়ার আশায়।জল ঢালার ব্যাপারটা হয়তো কৃষি উর্বরতার সমার্থক। এই শিবের প্রাগার্য রূপ পশুপতি, তিনি পশুদের বংশবৃদ্ধির দিকে নজর রাখেন।তিনি ঠিকক কি আমরা জানিনা, তবে সিন্ধু যুগের কিছু সীলে তাঁর চেহারার একটা আদল পাই। যাই হোক, আরাধ্য দেব হিসেবে তিনি সত্যিই দীর্ঘজীবী। ৩০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে মোটামুটি ২০০০ খ্রিষ্টাব্দ আর কোনও দেবতাটিঁকেছেন কি?তারপর, আর্য যুগেই যখন মাগধী বৌদ্ধ ধর্ম এলো, তখন অবলোকিতেশ্বর মানে বোধিসত্ত মৈত্রেয শিবের জায়গা নিলেন। ধর্মচিন্তায বৌদ্ধ দর্শন ঢুকে গেল। তার ছায়া পাই চর্যাগানে।সুফিরা তার মধ্যে ভক্তি আর সমর্পনের এলিমেন্ট ঢোকালো। সেই প্রথম প্রকাশ্য এল ভূমধ্যসাগরীয সেমিটিক ভক্তিবাদের পদক্ষেপ। সঙ্ঘবদ্ধ সংগীত ধর্মের এবং কালচারের অঙ্গ হয়ে গেল।শিবের প্রতীক যেমন লিঙ্গ, বোধিসত্বের প্রতীক হয়ে হয়তো স্তূপচিন্তা এল। ভেবে দেখলে বুঝবেন, স্তূপ আসলে শুধু মনুমেন্ট নয, মিসশেপেন লিঙ্গচিহ্নও বটে। আর, আজ কেন, তবে এক শতাব্দী আগেও, গান ছিল বাঙালি কালচারের কেন্দ্র। জন্ম, বিযে, অন্নপ্রাশন ধরণের পারিবারিক উত্সবে কিছুদিন আগেও মহিলারা সমবেতসুরে গান গাইতেন। সে গান তাঁরাই লিখতেন, তাঁরাই সুর দিতেন।
এমন ত্র্যহস্পর্শ ভারতভূমির অন্যান্য অংশে খুব কমই ঘটেছে। এ দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার একটা উদ্দেশ্য। আমার দ্বিতীয প্রতিপাদ্য হল, বৌদ্ধ ঢেউয়ের পরবর্তী বাঙলায় প্রায়ই মিনিয়েচর স্তূপ চিহ্ন দেখা যায়।আমি হুগলিতে, বীরভূমে দেখেছি। একেক জায়গায়, একেক রকমঃ অধিকাংশ মাটির, রৌদ্র পক্ব, জলে গলে যায়। কিছু পাথরের, ন্যাচরাল,স্কাল্পটেড নয। কিছু আবার পোডামাটির,লাল টেরাকোটা।উল্টনো বাটির মত একটা স্ট্রাকচার তৈরি করতে শিল্প সত্তা না থাকলেও চলে। কিন্তু গানগুলো সম্বন্ধে দুকথা বলা দরকার।
লৌকিক সঙ্গীত হিন্দিভাষী ভারতেও আছে, তবে তার ধরণ ধারণ আলাদা। গান পাখির কয়জন দিয়ে শুরু হলেও, মানুষের মুখে এসেছিলশ্রমজীবীদের মাধ্যমে। “পাল্কি চলে,হুহুমনা” আর পাথরভাঙারগানের কথা না বোঝালেন বুঝি। মেয়েদের গলাতেই সে শ্রনলাঘবের গান হয়তো ছাদপেটানো বিলাসপুর মহিলাদের অবদান। কিংবা হয়তো ঢেঁকিতে্যপার দেওয়া বাঙালি মেয়ে বউদের। কোথাও একটা একাত্মবোধ আছে নিশ্চয়ই, তাই রবীন্দ্রনাথের আইরিশ মেলোডি ভাঙা কোনও কোনও গানে কৈবর্তসংগীতের ভাব আসে। কখনও কানের মধ্যে বাল্মিকী প্রতিভার চটুল সংগীতের রেশ বাজে। তাই মেয়েরা যখন সমবেত সুরে তুসু বা ভাদুগান গায,তার রেশ গানের কথা পেরিয়ে বুকের মধ্যে বাজে। কিন্তু সর্বদা তেমন হয়না।
আমার ধারণা, এই সংগীত সাযুজ্যের মধ্যে গবেষণার োউপযোগী অনেক মেটিরিযাল লুকিয়ে আছে। গবেষণা হওয়া উচিত। এসব কথা যুক্তি দিয়ে নয, মনন দিয়ে বুঝতে হয। সেই জন্য এই কাহিনির অবতারণা। তার মানে গল্পটার দুটো ফ্যাসেটঃ একটা আক্ষরিক, অন্যটা রূপক।
ভারতভূথন্ডের যেখানে এই ত্র্যহস্পর্শ ঘটেনি, সেখানে অসহিষ্ণুতা আজও বাসা বেঁধে আছে।সুফি চিন্তা বাঙালীকে অপেক্ষাকৃত উদার করেছে।
গোবিন্দ সামন্ত ছিল আধা সাঁওতাল, তার মা পুরো সাঁওতাল। সে মামাবাডিতে মানুষ হয়েছিল- মামাবাডি, আসলে দাদুর বাডি । গ্রামে, পান্ডুযার কাছে। সেখানে তারা প্রান্তিকভাবে গ্রামবাসী। গ্রামটা আসলে একটাই যৌথ পরিবারের, সে পরিবারে একজনই কর্তা। সব রোজগারের সভ্য তাদের তামাম োউপার্জন তাঁর হাতে তুলে দেয। তিনি একাই বিলি ব্যবস্থার হকদার। গ্রামের স্কুল, বাজার, ধোপাখানা, দাওযাখানা সব কিছুই সেই ফ্যামিলির হাতে। তারা মুসলমান। অতএব গোবিন্দর দাদু বা তাদের মত আর যারা পরিবারের সদস্য নন, তারা প্রান্তিকভাবে পদবাচ্য। গ্রামটা আর তার চৌহদ্দি গাছে ঘেরা। বলা যায় বনাশ্রিত গ্রাম। গ্রামে আম-দাম-লিচু -কাঁঠালের অভাব নেই। জা়ফ়র আলি খানের কাটানো চার চারটে মস্ত পুকুর ভরা মাছ। অনেকেই ছাগল-পাঁঠা-হাঁস-মুরগি পালে। মাঘ মাসে মিনারের তলায যে মাসব্যাপী মেলা হয, সেখানে হাঁড়ির-কুড়ি- কাঁসা-পেতল-পেটা লোহার বাসন কোসন পাওয়া যায়, আর কত দরকারই টুকি টাকি।
আমি তখন কম্পাউন্ডিং ল্যাবে, মাছ ধরার শখ, পুরনো ঢিলে হয়ে যাওয়া ডায়ানার এয়ার রাইফেল দিয়ে পাখিও মারি, আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রোলিফ্লেক্স ২.৮ টি.এল. আরে নিসর্গ এবং মানুষ বন্দি করি। বয়স তখন কুড়ির একটু ওপরে।
গোবিন্দ আমার সমবযসী, মোটর কভার শপে টায়ার মেকার। সেই থেকে আলাপ। সে মাঝে মাঝে আমাকে তাদের সেই গাঁয়ের নিয়ে যেত। আমার সফর সঙ্গী ছিলেন কখনও জে.বি-দা কখনও চিক গনসালভেজ়।একবার খালি অবিনাশদা। ভোর ভোর আমার ল্যান্ডমাস্টার নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। গোবিন্দর বাড়িতে প্রাতঃরাশ। তার পর সারাদিন ছবি তোলা, মাছধরা, বা ইতি উতি ঘুরে ফিরতি পথে জি.টি. রোডের ওপর একটা ধাবায তডকা-রোটি দিয়ে লান্চ সেরে ঘরের পথ।
গোবিন্দর সঙ্গে ভাল থাতির জমে গিয়েছিল, সেই সুবাদে ইলছোবা-মন্ডলাইয়ের মুনিয়ার ছেলে সর্ফরাজের সঙ্গে। সর্ফরাজ তখন নৈহাটি কলেজের ইতিহাসের মাস্টার, দুর্দান্তে ছবি আঁকত, সবই ৬-নম্বর পেন্সিলে।রাজ আমাকে ধারে কাছের যাবতীয প্রত্নস্থান চেনাত।সেইই মগন সাঁইয়ের মাজ্হারের তলায যে গুপ্ত সুড়ঙ্গ ছিল তার খোঁজ দেয, আরও কয়েকটা সুফী মাজ্হার ছিল সে তল্লাটে, যদিও গ্রামটা োআর পাঁচটা মুসলমান হ্যাবিট্যাটের মত সুন্নি।
শেষবার, আমি গোবিন্দর সঙ্গে দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনা করছি, অবিনাশবাবু আমার আপিসে সিগারেট খেতে এসে সব শুনল, তারপর বলল, এবার আমাকে সঙ্গে নেবে? না, মাছ ধরার জন্য নয। তার পূর্বপুরুষের ভিটে নাকি ছিল মন্ডলীর গ্রামে, তখন গ্রামের নাম ছিল মধুপর্কপুর। সেআমলে তাদের একটা পারিবারিক শিব দেউল নাকি এখনও আছে। “দেখি তোমাদের সর্ফরাজ খুঁজে দিতে পারে কিনা। পারলে কৌশিক দেখিয়ে আনব পরে কথনও।”
সব শুনে রাজ বললে, “আপনারা কি সর্দার পাড়ায় ছিলেন, না মন্ডলপাড়ায়?
অবিনাশবাবু সে সব জানেন না, শুধু বললেন,” শুনেছি, সেখানে মাধবাচার্যের চতুষ্পাঠী ছিল, তার উত্তরদিকে পদ্মদিঘী।
রাজ টক করে ধরে নিল। “বুঝেছি, এখন যাবেন না দুপুরের ভাত খেয়ে?”
“খেতে তো সেই বডো রাস্তায় যেতে হবে শুনেছি।”
রাজ বললে, যদি অভয় দেন তো আমার গরিবখানায গৃহিনী ব্যবস্থা করেছেন। এদিকেই তো যেতে হবে। ভাবী আমাদের কামিনী চালের ভাত, সোনামুগ ডাল আর পুঁই শাক চচ্চডি খাওয়াল। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, আরেকটু সময পেলে মাছ মাংস করতে পারতাম, উনি তো সেসব বোঝেননা।
আমরা তার ঘরে পাতা গামছাবাঁধা দ্ই চিনি দিয়েখেযে মুখ মিষ্টি করলাম। অনেকদিন তত ভাল খাইনি। তারপর উত্তরের পদ্মদিঘী। পদ্মদিঘী জুডে নীল শাপলা ফুটে আছে, যেন নীলার খনি।আমার কালার ফিল্টার কাজে লাগল। তারপর সেই সুডঙ্গঅলা মাজ্হার। মাজ্হার পেরিয়ে একটা সরু ইটের স্তুপ, স্তুপের এককোণে একটা ছোট গাছগজানো স্তুপ, সেটাই নাকি শিবের দেউল, যদিও কিছু বোঝার উপায় নেই।অবিনাশবাবু সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। সেই কবে বাবা নিয়ে এসেছিলেন। তখন তো প্রাচীনত্বের মর্ম বুঝিনি। লোকে বলত, জাগ্রত শিব।
হঠাৎ কোত্থেকে চাপা গলায় নারীকন্ঠের গান ভেসে এল। কথাবোঝা যায়না,তবে খুব মায়াময় গানেই জনহীন জঙ্গলে কারা গাইছে, কোনই বা গাইছে?
রাজ বলল, এ গ্রামে একটা মেয়ে গানের দল আছে। আমার মেজ মাসী তার পান্ডা। তারা পুরনোদিনের বাঙলা গান রিভাইভ করছে, পারে লোকে ভুলে যায়।বিয়ের গান, উৎসবের গান। আসলে, অনেকেই জানেনা, যে বাঙলা গানের স্বর্ণযুগ ছিল সুফি আমলে, সুফি দর্শের োআদলে।
আমার এক ছাত্রী, এ নিয়ে রিসার্চ করছে।সকলকে অবাক করিয়ে দিয়ে অবিনাশবাবু প্রশ্ন করলেন, “কে, বন্দনায় তো?”
“আপনি বন্দনাকেও চেনেন।”
“বন্দনা আমার শ্যালিকার মেয়ে, সে আপনার সুখ্যাত করে খুব, তাই আপনাকেও চিনি।”
আমাদের সমবেত ঔৎসুক্য নিবারণ করতে অবিনাশবাবু বললেন,”বালির মোডের কাছে একটা কৈবর্তপাডা আছে, তোমরা কেউ জানো?”
হুগলি জেলের উল্টোদিকে সেই পাড়ার প্রবেশপথ।
অবিনাশবাবু যখন হাঁটু গেড়ে ভক্তি গদ্গদ, আমি তখন রাজ্যে প্রশ্ন করলাম,”এই মাজ্হারের সুডঙ্গটায ঢুকে দেখেছেন?”
“ওটা সুড়ঙ্গ নয, জাস্টিন একটা ডিপ্রেশন, হয়তো ম্যান মেড। চিন যুদ্ধের বছর ইমতিযাজ় মালি মাজ্হার সাফ করতে গিয়ে আচমকা খুঁজে পায। আমার এক প্রাক্তন সহপাঠী, মল্লিকা তখন, রক্তমৃত্তিকায শিক্ষানবিশি প্রত্ন তাত্ত্বিক, তাকে ডেকে নিয়েছিলাম। ভেতরে কিচ্ছু নেই, খালি একটা অর্ধবর্তুলাকার পাথর। মল্লিকা বলল, “মিসশেপেন শিবলিঙ্গ মনে হচ্ছে। ওই দেউলটার কথা তো সবাই জানতাম। আনি আবার প্রশ্ন করলাম, “ছবি আছে?” রাজ বললল, মাটিতে দাগ কেটে স্কীম্যাটিকটা বজঝাতে পারব।

“এটা দেখে আপনার মিস শেখেন ফ্যালিক সিম্বল মলে হল?”
“ আর কিম্বা মনে হবে?”
“ আমার তো মনে হচ্ছে সাঁচীস্তুপের মিনিয়েচর।”
কয়েক মুহূর্তর নৈঃশব্দের পর রাজ বলল, “এটা তো আমারই মনে হওয়া উচিত ছিল।” এখানে তো একটা বৌদ্ধবিহার ছিল বলে জনশ্রুতি। আরকিওলজিকাল সার্ভে বিস্তর খোঁডাখুঁডি করেও কিছু পায়নি।ইউ মে হ্যাভ হিট দ নেল অন দ হেড।”
রাজের বাডি থেকে একটা পালের টর্চ ধার করে আমিও ডিপ্রেশনটা দেখলাম। মিনিয়েচর বৌদ্ধ স্তুপ। কোনও সন্দেহ নেই।
সে যাত্রায রাজ খুশি, অবিনাশবাবু খুশি, আমি আশাতীত খুশি, আমরা খুশি বলে গোবিন্দর খপুব খুশি।