রূপকথার দেশ

[কয়ক পাই কম এক আনা স্মৃতিকথা,প্রায় ততটাই প্রত্নতত্তমূলক সত্য,বাকিটা দুচোখ মেলে স্বপ্ন দেখা]

মুখবন্ধ

আর্যরা কি ভারতের প্রথম অধিবাসী?

কয়েকটি ইন্ডো ইয়োরোপীয় ভাষাভাষী মধ্য এশীয় গোষ্ঠীকে একত্রে আর্য বলা হয়। যে উচ্চতায় তাঁরা থাকতেন, সেখানে সোমলতা (এফিড্রা) জন্মায়।সেই সোমরস পান করতেন তাঁরা। মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে ইওহিপ্পাস নামের এক চতুষ্পদ জন্তু ঘাস খেত। তাদের পোষ মানায় আর্যরা আর সেই নতুন প্রজাতির নাম অশ্ব [অশ্ব> horse, এবং ass]।তৃণভূমির বিবিধ তৃণ থেকে মানুষ গম, বাজরা, জুয়ার ইত্যাদি শষ্য তৈরি করে–দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে।ঘাসকে পোষ মানিয়ে খাদ্য শষ্য করার কৃতিত্ব আর্যরা একা নিতে পারেনা।

না আর্যরা ভারতের প্রথম অধিবাসী নয়। আফ্রিকাগত কোনও কোনও ট্রাইব পেনিনসুলার ভারতে ঢোকে আরও আগে। আন্দামান দ্বীপপুন্জে তাদের বংশধরের এখনও আছে বলে শোনা যায়।তা ছাড়াও খাইবার গিরিপথ দিয়ে অনেক জনজাতি এসেছিল আর্যদের আগে ও পরে।আর্যরা কোনওমতেই ভারতভূমির আদিবাসিন্দা নয়।

তবে তাদের ভাষাটা ছিল জোরালো, তাতে ঋগ্বেদ লেখা যেত, মহাকাব্য লেখা যেত, আর পাঁচটা কৌম ভাষাকে প্রভাবিত করা যেত। আর তারা কি দিয়েছিল এই দুনিয়াকে? একটা ধর্ম–তার নাম হিন্দুধর্ম।সে ধর্মের প্যান্থিয়ন ছিল সতত পরিবর্তনশীল।

হিন্দুধর্ম কতটা প্রাচীণ

বলা শক্ত। তবে ঋগ্বেদের ধর্ম হিন্দুধর্মের চেয়ে পুরনো। অধিকাংশ আদিম ধর্মের মত হিন্দু ধর্মও অন্যান্য ধর্মের ধারণা ও দেবতা আত্মসাত করে ধীরে ধীরে বেড়েছে।সেই অনুযায়ী সে তার নিজের থিওলজি ও থিওগনি সাজিয়ে নিয়েছে।সে আত্মীয়করণ আজও চলছে– যেমন সন্তোষী মা,সাঁই বাবা ইত্যাদি।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম তো আর্য ধর্ম, তাও বৌদ্ধধর্ম মান্যতা পেল বিদেশে । জৈন ধর্ম তো সনাতন ধর্মের সঙ্গে আপোস করতে করতে প্রায় হারিয়েই গেছে।

হিন্দু ধর্ম অবশ্যই খ্রীষ্ট ধর্মের (২০০০ বছর আগে খ্রিষ্টের জন্ম ধরলে) চেয়ে প্রাচীণ। মরুপ্রদেশের ইসলামিক ধর্মের চেয়ে অনেকটাই প্রাচীণ।

হিন্দু দেবতারারা


ঋগ্বেদে দেবতাদের ভীড়ভাট্টা কম।দুয়েকজন দেবতায়িত বীর ও গোষ্ঠীনেতা ছাড়া বাকিরা নেচার গডস ঃ সূর্য, চন্দ্র, বরুণ, ইত্যাদি। যম ছিলেন কারণ মৃত্যু একটা দুর্বোধ্য সমাপ্তি। সৃষটিকর্তা ব্রহ্মা, পালক বিষ্ণু ছিলেন। যিনি ত্রিলোক ধ্বংস করেন, সেই মহেশ্বরও ছিলেন,কিন্তু তিনি হয়তো প্রাগার্য।সিন্ধু-সারস্বত সভ্যতার নগরাবশেষ থেকে শৃঙ্গ বিশিষ্ট এবং নানা জন্তুজানোয়ার পরিবৃত যে মুর্তি দেখা যায় তাঁকে পশুপতি অভিধান চিহ্ণিত করে মহাদেবের সঙ্গে অভিন্ন বলে ধরা হয়। পদ্ধতি বা মহামারীর সময়ে অনিয়ন্ত্রিত লোকক্ষয়ে যখন বংশ বা কৌমলোপের সম্ভাবনা দেখাদেয়, তখনও কিন্তু এই দেবতাই লোকবৃদ্ধির অধিদেবতা হয়ে কৌম রক্ষা করেন।তাই আজও তিনি ফ্যালিক সিম্বল হিসেবে পূজিত হন।তিনি আদিদেব, দেবাদিদেব, আর্যদের চেয়ে অনেক পুরনো এবং সর্ব কৌমে পূজিত।তিনি তাণ্ডব নাচলে সৃষ্টি মন করে বটে কিন্তু তিনিই গুটিবসন্ত বা পশ্চিমা দস্যুদের হানা থেকে আমাদের রক্ষা করেন। আমাদের ‘দেব’ শব্দ সুদূর পশ্চিমে গিয়ে জ়িউস হয়ে গেছে।কিন্তু ভারতভূমির বাইরে কোনও মহাদেব নেই।

রামায়ণ


আদিকবি বাল্মিকীর নামে চলে, যদিও স্বয়ং বাল্মিকী নাকি লিখেছেন যে রামের কাহিনি আগেও বহু কবি লিখেছেন, পরেও অনেকে লিখবেন।বাল্মিকী রামায়ণের কবি হিসেবে যাঁদের অগ্রগণ্য ভেবেছেন তাঁরা ভারতসীমানার মধ্যেকার মানুষ নাওহতে পারেন। বালিদ্বীপে যদি ভারতের রামকথা পৌঁছতে পারে, তবে ভারতের বাইরে থেকে ভারতে কেন নয়? লিখিত মহাভারত কত পুরনো?নিশ্চয় করে বলার মত যথেষ্ট তথ্য নেই। ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী আমাদের প্রাচীণতম লিপি–অপঠিত সিন্ধুলিপিকে সরিয়ে রাখলে। দেশীয় ভাষায় সে লিপিতে সবচেয়ে পুরনো লেখা। যা আমরা খুঁজে পেয়েছি তা হল অশোকের শিলালিপি (died 238 bc). হয়তো নশ্বর ভুর্জপত্র বা তাল পত্রে লেখা হত তার আগে, কিন্তু তারও কোনও উল্লেখ নেই কোথাও। তাই প্রশ্ন থেকে যায়, ১) রাম কি ঐতিহাসিক ব্যক্তি? ২)তিনি কি ভারতবর্ষীয়?

অ+উ+ম্ এই যুক্তবর্ণের নাম নাকি ওঁ, এবং সেটি নাকি অতি পবিত্র এক ধ্বনি।লিপির প্রাচীনত্ব নিয়ে সন্দেহ তালে ওঁ-কেও বর্তায়।

কবে রচিত হয়েছিল এই মহাকাব্য? হিসেব নেই।কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা বলেন পাঁচ হাজার বছর আগে।কিন্তু আমাদের প্রথম পাওয়া লিপি, অশোকের শিলালেখ মোটে ২৩০০ বছরের পুরনো। তার আগে লিপি আবিষ্কারই হয়নি , বা হলেও নশ্বর পাত্তায় লেখা হত। রামায়ণের গল্প এশিয়ার অন্যত্রও প্রচলিত। আমাদের অন্য মহাকাব্যের তেমন প্রচলন নেই। এমন কি হতে পারে যে রামায়ণের ঘটনাসমূহ অন্যত্র কোথাও ঘটেছিল। সে গল্প লোকমুখে ভারত অবধি পৌঁছেছিল। সেখানেই কাব্যরূপ পেয়েছে? বাল্মিকী স্বয়ং স্বীকার করেছে যে রামায়ণ কথা তাঁর পূর্বে অনেকে বলেছেন। এ কাহিনী বহিরাগত হতেও তো বাধা নেই। রামকে ঐতিহাসিক চরিত্র বলে মেনে নেবার পক্ষে প্রমাণ আছে কিছু?


ধ্বংসের পর সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার লোকেরা কোথায় গেল?

চারদিকে ছড়িয়ে গেল; কোথায় আর যাবে? হয় পূর্ব নয়তো দক্ষাণমুখী।মানুষ গুলো তো ধ্বংস হয়নি।কেউ কেউ নিশ্চয় দুমকা গিয়েছিল, কারণ দুমকায় আমি একটা ডলমেনম।



সেটা হয়তো ১৯৫২ কি ৫৩ সাল। বাবা-মার সঙ্গে পৌষমেলার শান্তিনিকেতন গেছি। সেখানে শুনলাম, বাবুই পিসির একটাদুর্ঘটনা হয়েছে। বাবুই পিসি বাবার প্রায় সমবয়সী মাসতুত বোন। দেশভাগের আগে রাজশাহী কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। তিনিই স্বেচ্ছায় জনৈক সীতানাথ ঘোষকে বিবাহ করেন। সীতানাথ তখন কলকাতায় মেডিকাল পড়ছেন।দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে আমার ঠাকুমার পরিবার বাবুইকে নিয়ে কলকাতা চলে আসেন, হাজরার সাবেক বাড়িতে।বাবুইয়ের বিয়েটা তাঁর বাড়িতে সহজে মানা হয়নি। একে অসবর্ন, তায় প্রতিলোম। অর্থনৈতিক আপত্তিও ছিল।সীতানাথ ডাক্তার পাশ করে তাঁর সামান্য পুঁজি দিয়ে দুমকা শহরে একটা চালু ওষুধের দোকান কিনলেন।তখনও সেটা বাঙলায়।দীর্ঘকাল তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন।

১৯৫২-র মাঝামাঝি তাঁর সন্তানসম্ভাবনা হয়। ৫৩-র শীতে একটা সাধারণ দুর্ঘটনায় তাঁর গর্ভপাত হয়ে যায়।

দুমকা আর তার লাগোয়া জামতাড়া দুটোই স্বাস্থকর জায়গা বলে প্রসিদ্ধ ছিল পেটরোগা বাঙালি বাবুদের কাছে।কেউ কেউ বলতেন দুমকার কুয়োর জল খেলে নাকি পাথরও হজম হয়ে যায়। দুমকা নামটা শুনলেই কেমন একটা খটকা লাগে। সীতানাথ মেসো বলতেন, শব্দটা ফার্সি, মানে হচ্ছে পাথুরে সীমান্ত। পাথুরে তো বটেই, স্বাধীনতার আগে দুমকা ছিল বাঙলার অংশ।

তাই আমার প্রথম দেখা দুমকা/জামতাড়া না ঘাটকা না ঘরকা হয়েই ছিল।

সে দুমকার বাইরে আরও দুটো দুমকা আমি চিনতামঃ প্রথমটা বাবার শা’গন্জের সান বারান্ডা ফ্ল্যাটের ১১৬/l১১৫ ম্বরেরের জোড় পেছবারান্দায়। সেখানে আমাদের মহাদেব দাস বৈরাগীর সঙ্গে আড্ডা দিত সন্তুদের বাড়ির নন্দলাল দুবে, নানকি মাহাতো আর দুখন মাঝি। শেষ তিনজন দুমকার মানুষ। মহাদেব নদিয়া জেলার পলাশির লাগোয়া মুর্শিদাবাদের বাছরা গ্রামের।দুমকার তিনজনই দুমকাকে রূপকথার দেশ বলে জানত। নন্দলাল তো আসলে মৈথিলী ব্রাহ্মণ, দুমকার অনেকটা উত্তরে তার দেশ। পেটের দায়ে সে দুমকার পাথর খাদানে কাজ করত। তার পর তিনজনই পেটের দায়ে শা’গন্জ লোকের বাড়ি কাজ করতে এসেছে। তারা বর্হমদেও, কারিয়া প্রেত আর বিহারী হিন্দিতে যাদের চুড়্ঐল বলে, সেই ডাইনিদের কাছ থেকে দেখেছে। তারা আকছির দুমকার জংগলে ঘোরেফেরে। দক্ষিণারন্জনের রূপকথা আমাদের অত শিক্ষা দেয়নি।অন্যটা হল, লীলা মজুমদারের হলদে পাখির পালক। সেটাও আসলে দুমকার গল্প। বাবুই পিসি সীতানাথ পিসে হলেন দুমকার তৃতীয় বাহু।

সীতানাথের কর্মস্থল দুমকা শহরে, কিন্তু খরচের দায়ে তিনি আস্তানা গেড়েছিলেন শহরের একপ্রান্ত, জঙ্গলের লাগোয়া মাঝিপাড়ায়।রানিগন্জটালিতে ছাওয়া মেটে বাড়িতে। বাসার পাশেই একটা ডোবা, ঝিঁঝিঁ ডোবা। তার জলে নাইলেই নাকি জ্বর হয়ে লোকে মরে যায়। দোকান অবধি ৪ মাইল রাস্তা পিসেমশাই সাইকেলে যাতায়ত করতেন।বাবুই পিসির গর্ভাবস্থায় তাঁকে সাহায্য করত লছমি মেঝেন। সাহায্য মানে, চাড্ডি বাজার করা, রান্না করা, ঘর সাফ করা, রোজকার কাপড় কাচা। ওদিকে নন্দলাল বলত, ওই ঝিঁঝিঁ ডোবাতেই নাকি চুড়ৈল ওড়ে।পিসিরা বেমালুম অস্বীকার করল।”ছবিটার ছেলে হয়ে তুই এসব বিশ্বাস করিস?”

বিশ্বাস না করেই বা যাই কোথায়। আঁধার যখন থমথমিয়ে নামে, ভয় করে যে।কিসের ভয়? কি জানি কিসের, কিন্তু করে। জোনাক জ্বলা অন্ধকারে নীল শালিকের গাদাটা বেশ ভয়ের। তায় আবার ঝিঁঝিঁর ডাক। তার মধ্যে বুড়ো দাদু একা বসে থাকে, একটাও কথা বলে না। বুড়ো হল বাবুই পিসির শ্বসুর। একশোর কাছাকাছি বয়স। আগে ছিলেন মুঙ্গের ভাগলপুরের ডিপটি। পরে লেখক বনফুল তাঁকেযত্ন করে জামতাড়ায় পাঠিয়ে দেন। পিসেমশাই এখন তাঁর ভার নিয়েছেন।তিনি সারাদিন শালুকডোবার জলে পাডুবিয়ে বসেথাকেন। কথা বললে নিজের মনেই বলেন। সারা দিনে দুটো রুটি আর দুভাঁড় মাঠা খান।পোলিও জীবানুগত তিন বছরে তাঁর কোনও ক্ষতি করতে পারেনি।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান