কৈবর্তদের গান

গোবিন্দ সামন্ত ছিল আধা সাঁওতাল, তার মা পুরো সাঁওতাল। সে মামাবাডিতে মানুষ হয়েছিল- মামাবাডি,/আসলে দাদুর বাডি ইলছোবা মন্ডলাই গ্রামে, পান্ডুযার কাছে। সেখানে তারা প্রান্তিকভাবে গ্রামবাসী। গ্রামটা আসলে একটাই যৌথ পরিবারের, সে পরিবারে একজনই কর্তা। সব রোজগেরে সভ্য তাদের তামাম উপার্জন তাঁর হাতে তুলে দেয। তিনি একাই বিলি ব্যবস্থার হকদার। গ্রামের স্কুল, বাজার, ধোপাখানা, দাওযাখানা সব কিছুই সেই ফ্যামিলির হাতে। তারা মুসলমান। অতএব গোবিন্দর দাদু বা তাদের মত আর যারা পরিবারের সদস্য নন, তারা প্রান্তিক পদবাচ্য। গ্রামটা আর তার চৌহদ্দি গাছে ঘেরা। বলা যায় বনাশ্রিত গ্রাম। গ্রামে আম-জাম-লিচু -কাঁঠালের অভাব নেই। জা়ফ়র আলি খানের কাটানো চার চারটে মস্ত দিঘীপ্রতীম পুকুর ভরা মাছ। অনেকেই ছাগল-পাঁঠা-হাঁস-মুরগি পালে। মাঘ মাসে মিনারের তলায যে মাসব্যাপী মেলা হয, সেখানে হাঁড়ি-কুড়ি- কাঁসা-পেতল-পেটা লোহার বাসন কোসন পাওয়া যায়, আর কত দরকারি টুকি টাকি।
আমি তখন কম্পাউন্ডিং ল্যাবে, মাছ ধরার শখ, পুরনো ঢিলে হয়ে যাওয়া ডায়ানা এয়ার রাইফেল দিয়ে পাখিও মারি, আর উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রোলিফ্লেক্স ২.৮ টি.এল. আরে নিসর্গ এবং মানুষ বন্দি করি। বয়স তখন কুড়ির একটু ওপরে।
গোবিন্দ আমার সমবযসী, মোটর কভার শপে টায়ার মেকার। সেই থেকে আলাপ। সে মাঝে মাঝে আমাকে তাদের সেই গাঁয়ে নিয়ে যেত। আমার সফর সঙ্গী ছিলেন কখনও জে.বি-দা কখনও চিক গনসালভেজ়।একবার খালি অবিনাশদা। ভোর ভোর আমার ল্যান্ডমাস্টার নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। গোবিন্দর বাড়িতে প্রাতঃরাশ। তার পর সারাদিন ছবি তোলা, মাছধরা, বা ইতি উতি ঘুরে ফিরতি পথে জি.টি. রোডের ওপর একটা ধাবায তডকা-রোটি দিয়ে লান্চ সেরে ঘরের পথ।
গোবিন্দর সঙ্গে ভাল থাতির জমে গিয়েছিল, সেই সুবাদে ইলছোবা-মন্ডলাইয়ের মুখিয়ার ছেলে সর্ফরাজের সঙ্গে। সর্ফরাজ তখন নৈহাটি কলেজের ইতিহাসের মাস্টার, দুর্দান্তে ছবি আঁকত, সবই ৬-নম্বর পেন্সিলে।রাজ আমাকে ধারে কাছের যাবতীয প্রত্নস্থান চেনাত।সেইই মগন সাঁইয়ের মাজ্হারের তলায যে গুপ্ত সুড়ঙ্গ ছিল তার খোঁজ দেয, আরও কয়েকটা সুফী মাজ্হার ছিল সে তল্লাটে, যদিও গ্রামটা আর পাঁচটা মুসলমান হ্যাবিট্যাটের মত সুন্নি।
শেষবার, আমি গোবিন্দর সঙ্গে দিনক্ষণ নিয়ে আলোচনা করছি, অবিনাশবাবু আমার আপিসে সিগারেট খেতে এসে সব শুনল, তারপর বলল, এবার আমাকে সঙ্গে নেবে? না, মাছ ধরার জন্য নয। তার পূর্বপুরুষের ভিটে নাকি ছিল মন্ডলাই গ্রামে, তখন গ্রামের নাম ছিল মধুপর্কপুর। সেআমলে তাদের একটা পারিবারিক শিব দেউল নাকি এখনও আছে। “দেখি তোমাদের সর্ফরাজ খুঁজে দিতে পারে কিনা। পারলে কৌশিককে দেখিয়ে আনব পরে কথনও।”
সব শুনে রাজ বললে, “আপনারা কি সর্দার পাড়ায় ছিলেন, না মন্ডলপাড়ায়?
অবিনাশবাবু সে সব জানেন না, শুধু বললেন,” আমরা তো কৈবর্ত,শুনেছি, সেখানে মাধবাচার্যের চতুষ্পাঠী ছিল, তার উত্তরদিকে পদ্মদিঘী।সেটা পেরিয়ে।
রাজ টক করে ধরে নিল। “বুঝেছি, এখন যাবেন না দুপুরের ভাত খেয়ে?”
“খেতে তো সেই বডো রাস্তায় যেতে হবে শুনেছি।”
রাজ বললে, যদি অভয় দেন তো আমার গরিবখানায গৃহিনী ব্যবস্থা করেছেন। এদিকেই তো যেতে হবে। ভাবী আমাদের কামিনী চালের ভাত, সোনামুগ ডাল আর চিংড়ি দিয়ে পুঁই শাক চচ্চডি খাওয়াল। লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, আরেকটু সময পেলে মাছ মাংস করতে পারতাম, উনি তো সেসব বোঝেননা। গেরস্তের একটা ক্র্তব্য়্ আছে না।
আমরা তার ঘরে পাতা গামছাবাঁধা দ্ই চিনি দিয়েখেযে মুখ মিষ্টি করলাম। অনেকদিন তত ভাল খাইনি। তারপর উত্তরের পদ্মদিঘী। পদ্মদিঘী জুডে নীল শাপলা ফুটে আছে, যেন নীলার খনি।আমার কালার ফিল্ম কাজে লাগল। তারপর সেই সুডঙ্গঅলা মাজ্হার। মাজ্হার পেরিয়ে একটা সরু ইটের স্তুপ, স্তুপের এককোণে একটা ছোট গাছগজানো স্তুপ, সেটাই নাকি শিবের দেউল, যদিও কিছু বোঝার উপায় নেই।অবিনাশবাবু সেখানে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। সেই কবে বাবা নিয়ে এসেছিলেন। তখন তো প্রাচীনত্বের মর্ম বুঝিনি। লোকে বলত, জাগ্রত শিব।
হঠাৎ কোত্থেকে চাপা গলায় নারীকন্ঠের গান ভেসে এল। কথাবোঝা যায়না,তবে খুব মায়াময় গানেই জনহীন জঙ্গলে কারা গাইছে, কোনই বা গাইছে?
রাজ বলল, এ গ্রামে একটা মেয়ে গানের দল আছে। আমার মেজ মাসী তার পান্ডা। তারা পুরনোদিনের বাঙলা গান রিভাইভ করছে, পাছে লোকে ভুলে যায়।বিয়ের গান, উৎসবের গান। আসলে, অনেকেই জানেনা, যে বাঙলা গানের স্বর্ণযুগ ছিল সুফি আমলে, সুফি দর্শেনের সংগে্ েবৌদ্ধ ধারণাএ মিলিত আদলে।
আমার এক ছাত্রী, এ নিয়ে রিসার্চ করছে।সকলকে অবাক করিয়ে দিয়ে অবিনাশবাবু প্রশ্ন করলেন, “কে, বন্দনা তো?”
“আপনি বন্দনাকে চেনেন।”
“বন্দনা আমার শ্যালিকার মেয়ে, সে আপনার সুখ্যাত করে খুব, তাই আপনাকেও চিনি।”
আমাদের সমবেত ঔৎসুক্য নিবারণ করতে অবিনাশবাবু বললেন,”বালির মোডের কাছে একটা কৈবর্তপাডা আছে, তোমরা কেউ জানো?”
হুগলি জেলের উল্টোদিকে সেই পাড়ার প্রবেশপথ।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান