কবিতার স্ক্র্যাপবুক ৫ (অন্তিম)

আমার ওয়েব লগের কোনও নিষ্ঠাবান পাঠক নেই; যদি থাকত, তাঁরা না বলতেই বুঝতেন যে তাঁর  যুগের কবি হিসেবে তারাপদ রায়ের ওপর আমার যথেষ্ট দুর্বলতা। তাঁর আগের যুগের কবিদের নিয়ে আমার ধন্দ আছে — অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত না শঙ্খ ঘোষ? দুজনে এত আলাদা যে ঠাহর করা মুশকিল, একজনকে বেছে নেয়া আরও দুরূহ। অলোক যখন আলতো করে বলেন,

“নতুন মন্দির হবে বলে

কেউ বা মোহর দিল, কেউ বা কাহন,

যে শিশু দোলায় শুয়ে দোলে

সে তার দোলন টুকু দিয়ে দিল…”

অথবা

মাঝে মাঝে মনে হয় ঈশ্বর আছেন,

মগডালে বসে থাকা পাপিয়াকে আর

পর্যবসিত এই বস্তুপৃথিবীকে

ধারাস্নানে স্নান করাচ্ছেন…”

তখন আমার অন্তরের সযত্নলালিত অবিশ্বাস, আকৈশোর নাস্তিকতা ঢেকে বিস্ময়াকুল সংশয়বাদ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় দিদিমনির নাকের বেশরে আগুন ঝলসায়, মরাঠি প্রজাপতি হাপ-আখড়াই গায়, তাঁর দৃষ্টিতে শহরের রাস্তার ক্লেদাক্ত দৃশ্যও ধরা পড়ে, তাই তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন,  “গাড়ি চাপা পড়ে একটি কুকুর হয়েছে সুমধ্যমা।” এমনকি প্রাচীন আমাদের লেখা-তে ছাপা তাঁর বাল্যকবিতাও সম্ভাবনার রসে সিক্ত।

শঙ্খ সে তুলনায় বড্ড কম লিখেছেন, লিখেছেন বাবরের প্রার্থনা-র মত শুদ্ধ মননের কবিতা, অথবা তাঁর অস্ফূট স্বগত কথনে 

“নষ্ট হয়ে যাবার পথে গিয়েছিলুম, প্রভু আমার!
তুমি আমার নষ্ট হবার সমস্ত ঋণ
কোটর ভরে রেখেছিলে।
কিন্তু আমার অমোঘ মুঠি ধরে বুকের মোরগঝুঁটি
সন্ধ্যাবেলা শুধু আমার মুখের রঙে
ঝরে পড়ার ঝরে পড়ার
ঝরে পড়ার শব্দ জানে তুমি আমার নষ্ট প্রভু!”

তিনিই আবার অর্ধোচ্চারিত প্রতিবাদী ব্যঙ্গে ২০০৯ সালে বলেন

“আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে
যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে৷
দাপিয়ে বেড়াবে আমাদের দল অন্যে কবে না কথা
বজ্র কঠিন রাজ্যশাসনে সেটাই স্বাভাবিকতা৷
গুলির জন্য সমস্ত রাত সমস্ত দিন খোলা
বজ্র কঠিন রাজ্যে এটাই শান্তি ও শৃঙ্খলা৷
যে মরে মরুক, অথবা জীবন কেটে যাক শোক করে—
আমি আজ জয়ী, সবার জীবন দিয়েছি নরক করে৷”

অবশ্য সমকালের সব তুলনার ঊর্ধ্বে থাকবেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়; তাঁর মত কবি সব দেশেই বিরল, রবীন্দ্রোত্তর যুগের নিরিখে তো বটেই। শক্তির কথা উঠলে আনন্দ-গোষ্ঠীর রীতি অনুযায়ী সুনীলের নাম উঠবেই। সুনীল অবশ্যই খাটিয়ে গদ্যকার, শেষ যামে বিস্তর গবেষণা করে বেশ কয়েকটা ভালো উপন্যাস লিখেছেন; কবি হিসেবে তাঁর বিচার না হলেও কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমি সেই সব বড় বড় নাম নিয়ে লিখছিনা আজ, আমার ভালো লাগা দু’একজন কবির কথা বলতে চেষ্টা করছি — তাঁরা আজ প্রায় অপঠিত। আর এ লেখায়  টেকনিকাল খুঁটিনাটির কচকচি নেই, নেই কারণ শুধু সংজ্ঞা দিয়ে কবিতার জাত বিচার চলে না।

তারাপদর পরে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ গড়ে ওঠেনি — হয়ত বয়সের বৈষম্যে, হয়ত তাঁদের ইডিয়ম আমার আয়ত্তের বাইরে বলে, হয়ত আমারই অমনোযোগে। আসলে বোধহয় তাঁদের উত্থান মুহুর্তে আমার কবিতার তৃষ্ণা মিটে গিয়েছিল সাময়িক, পরে আর দানা বাঁধেনি। ভেবে দেখলেই স্পষ্ট যে জয় গোস্বামী খুবই ভালো কবি, তবু কোথায় যেন তাঁর মধ্যে শক্তির প্যাশন বা তারাপদর তারল্যের তুলনীয় কোনও সযত্ন স্বাক্ষর নেই। লোপামুদ্রার কন্ঠে বেনীমাধব  বেরুনোর পর তাঁর সাধারণ্যে নামডাক। আর শ্রীজাত বিনা ভনিতায় ব্যবসায়িক কবিতায় নিবৃত্ত। ষাট-সত্তরের মত কবিতার মাতামাতিও নেই, গুচ্ছের চরিত্রবান ক্ষুদ্রপত্র — স্বল্পায়ু কিন্তু তীক্ষ্ণ — যেন কোথাও নির্বাসনে। কবিতা-পরিচয়-কৃত্তিবাস-কলকাতা-সারস্বতের মত পথিকৃতরা লুকিয়ে পড়েছে। এককালে, সেই ময়দানের মুক্তমেলার যুগে, রাশি রাশি কবিতাপত্র বেরুত —  সাপ্তাহিক, দৈনিক, মায়  ঘন্টিকীও। সেই উত্তেজনার আগুন কি আজ আমার চোখেই ধরা পড়ছে না শুধু? …

তারাপদর কলম নিখাদে থেকেও, উচ্চকিত৷ প্রতিবাদে নয়, কখনও রহস্যে, কখনও যৌনতায় (যে নৈর্ব্যক্তিক, অশরীরী যৌনতাকে মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি জেনারেশন অবজ্ঞার চোখে দেখত একদা), অধিকাংশ সময়েই অলস দৃশ্যচিত্র আঁকতে তৎপর। তাঁর মত চিত্রকল্পের চিত্রী সত্যিই বিরল। তিনি অনায়াসে লিখতে পারেন,

“বঙ্গোপসাগর থেকে ছুটে এলো ক্ষিপ্র দ্রুতশ্বাস

চুনি গোস্বামীর মত সাবলীল, সহজ বাতাস।”

তিনিই, একমাত্র তিনিই, কলমের খোঁচায় আঁকতে পারেন স্মাইল প্লীজ-এর মত চিত্রময় ছবি তোলার কবিতা। কিংবা,

“ঝোপের ভিতরে বাঘ, পোড়া বারুদের গন্ধ,

দ্রুত ছুটে যাওয়া পলাতক রক্তের ফোঁটায়

ছিল স্বপ্নে আমারও চঞ্চলতা …

তবু বার বার কেন জঙ্গলের গল্পে ফিরে যাও?

বন্দুকের নল, রক্তের ফোঁটা,

কেন আমাকে শিকারী কুকুরের সঙ্গে

কেন ছুটতে বলো?”

আজ যে কবিতায় স্ক্র্যাপবুক  পর্যায়ে ইতি টানবো, সেটা তারাপদর নয় কিন্তু কেমন যেন তারাপদগন্ধী; শুনলে আনন্দ বাগচী খুশি হবেন না একটুও। শান্তিনিকেতনের কেউ কেউ হয়তো মনে রেখেছেন, এই আনন্দ বাগচীই একদা বর্ষারাঙা কোপাইয়ের ঢলকে আলতার শিশি ভাঙার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। 

আমার বিচারের সঙ্গে আপনার বিচার যে মিলবেই এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই; তা ছাড়া বিচার করার আমি কে?     

লন্ঠন জ্বালিয়েআনন্দ বাগচী (‘দেশ’, ১২.১২.১৯৬৪)

সমস্ত জীবন যেন লন্ঠন জ্বালিয়ে এই ডাকবাংলোয় বসে থাকা,

টিলার ওপরে রাত্রি, মোরগের মত রক্তজবা,

কিছু দূরে চ্ছল চ্ছল নদীর ধমনী, বাজে

অদৃশ্য ট্রেনের হুইসল।

সাঁওতাল যুবতী তার ঘরে ফিরে গেছে একা, আদিম শরীরে,

আচ্ছন্ন বৃষ্টিতে ঝরছে সারা পথ সেগুনের ফুল,

দুঃখ সুখ প্রেম স্মৃতি সব একাকার হয়ে গেল।

ঘরের দেওয়ালগুলো অনুতাপে ঘন হয়ে আসে,

ছায়াগুলো ভেঙে গিয়ে আবার নিজের জায়গায়

দাঁড়িয়ে নিঃশব্দ ভূমিকায়।

লন্ঠনের আলো শুধু নিরন্তর জিজ্ঞাসায় জ্বলে,

আদিম শরীর, বৃষ্টি, সেগুনের ফুল, স্মৃতি, জুয়া,

অব্যক্ত নদীর জল, ধমনীর রক্ত আর ট্রেনের হুইসল।

বাহিরে অজ্ঞাত রাত্রি পাশ ফেরে ভোরের আলোয়।।